ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতি
--------------------------
✍ এই শিরোনামের মধ্যে 2 টি শব্দ আছে ৷ প্রথম শব্দটি হল ব্রাহ্মণ্যবাদ আর দ্বিতীয় শব্দটি হল রাজনীতি ৷ মূল আলোচনার বিয়টি হবে রাজনীতি ৷ তবে প্রথমেই ব্রাহ্মণ্যবাদ সম্পর্কে কিছু মৌলিক আলোচনা করে নেওয়া যাক ৷
✒ ব্রাহ্মণ্যবাদ সম্পর্কে ভারতের শূদ্র ও অস্পৃশ্য সমাজের উদ্ধারকর্তা এবং স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণেতা ড: বি, আর, আম্বেদকর বলেছেন—"ব্রাহ্মণ্যবাদের মূলনীতি তিনটি ৷ (1) অসাম্য, (2) বিভেদ ও (3) শোষণ ৷" তিনি আরো বলেছেন—" ভারতের শূদ্রদের নিকট ব্রাহ্মণরা হল তেমন বিদেশী, জার্মানীতে জেন্টিলরা যেমন বিদেশী ৷" তামিলনাড়ুর সমাজ সংস্কারক ও শূদ্রনেতা পেরিয়ার ই,ভি, রামস্বামী বলেছেন—"ব্রাহ্মণ গোখুরো কেউটে সাপের থেকে বেশী বিষাক্ত ৷ সাপের বিষ থাকে তার দাঁতের চোয়ালে আর ব্রাহ্মণদের বিষ থাকে গোটা শরীরের লোমকূপে ৷" প: বাংলার প্রয়াত বিখ্যাত দলিত সাহিত্যিক রণজিত কুমার সিকদার বলেছেন—" ধর্মীয় কলাকৌশলে সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক শোষণের এক অভিনব পরিকল্পনার নাম হল ব্রাহ্মণ্যবাদ ৷"
উপরে তিনজন স্বনামধন্য সমাজ সংস্কারকগণ যা যা বলেছেন তার মর্মার্থ হল— " ব্রাহ্মণদের মস্তিষ্ক থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের সৃষ্টি হয়েছে ৷ ব্রাহ্মণ্যবাদ মতবাদ হিসাবে পৃথিবীর মধ্যে একটি নিকৃষ্ট ধরণের মতবাদ ৷ ব্রাহ্মণ্যবাদের মাধ্যমে মানুষদেরকে শোষণ করা হয় ৷ অন্য কথায় বলা যায় যে ভারতের শূদ্র ও গরীব এবং নারী সমাজকে ও অস্পৃশ্যদেরকে শোষণ করার জন্য ব্রাহ্মণরাই ব্রাহ্মণ্যবাদকে সৃষ্টি করেছে ৷" ব্রাহ্মণ্যবাদ যে কি জিনিস, তা কত ভয়ঙ্কর বা কত বিষাক্ত সেটা ভারতের শূদ্র সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু , MA, MSc, PHD, D Lit, Barrister ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সমাজ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক, মহাবিপ্লবী, ব্রাহ্মণদের হিন্দু ধর্ম প্রত্যাখ্যানকারী ও আজীবন সংগ্রামী নেতা ড: বি, আর, আম্বেদকর গভীরভাবে উপলব্ধী করেছিলেন বলেই তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদ সম্পর্কে নির্দ্বিধায় অত বড় বড় মন্তব্য করতে সাহস করেছিলেন ৷ পাটনার বুদ্ধ শরণ হংস তাঁর "ব্রাহ্মণ্যবাদ সে বাচো" হিন্দী বই তে লিখেছেন যে—"হিন্দু ধর্মের সোজা অর্থ হল ব্রাহ্মণ্যবাদ ৷ ব্রাহ্মণ্যবাদের সোজাসুজি অর্থ হল ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় নির্দেশ মান্য করা ৷ ব্রাহ্মণ সবথেকে পূজনীয় এবং জাত মান্য করা অনিবার্য, এটাই ব্রাহ্মণ্যবাদ ৷ "
বামসেফ (BAMCEF) সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি ওয়ামান মেশরাম সাহেব বলেছেন—" ভারত মেঁ সভী সমস্যাওঁ কা মূল কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদ হ্যায় ৷" অর্থাৎ ভারতের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ হল ঐ ব্রাহ্মণ্যবাদ ৷
আশাকরি, আমাদের নিকট এতক্ষণে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে গেছে ৷ তাহলে এখন একথা অবশ্যই বলা যায় যে, " ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে সাবধান ৷" ড: আম্বেদকর একখানা বইয়ের নাম দিয়েছিলেন— "তফসিলীরা গান্ধীজী থেকে সাবধান ৷" তিনি আরো বলেছেন, "গান্ধীবাদ অস্পৃশ্যদের মৃত্যুদণ্ড ৷
এরপর আমি আলোচনা করব রাজনীতি সম্পর্কে ৷ "রাজনীতি" শব্দটি পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রথমে ব্যবহার করেছিলেন এ্যারিষ্টোটল ৷ গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিষ্টোটল এবং রূশো, ল্যাস্কি, কার্লাইল, আর্ণেষ্ট বার্কার প্রমুখ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ হলেন বর্তমান রাজনীতির স্রষ্টা ৷ রাজনীতি সম্পর্কে তাঁদের মতামত হল—" মানুষের কল্যাণ করাই হল রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ৷ দুর্বল, পরনির্ভরশীল, নারী, শিশু, পঙ্গু ও অসহায় মানুষদের কল্যাণ ও উন্নয়ণে সক্রিয়ভাবে সেবা করে যাওয়া হল রাজনীতির চরম ও পরম লক্ষ্য ৷ "
বর্তমান যুগের আধুনিক রাজনীতি, গণতণ্ত্র, নির্বাচন, জনমত, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, মিডিয়া, মানুষের অধিকার এসমস্ত বিষয়ে প্রাচীন যুগের মানুষদের সুস্পষ্ট কোন ধারণা ছিলনা ৷ আমাদের ভারতে মনুর লেখা "মনুস্মৃতি" আর রাজার ইচ্ছাই হল দেশের আইন ৷ ব্রাহ্মণের জন্য দেশের আইন হল - "ব্রাহ্মণের সাত খুন মাপ ৷" শূদ্রদের পক্ষে কোন আইন নেই ৷ শূদ্রদের কোন অধিকার নেই ৷ শূদ্র অর্থাৎ এদেশের আদি বাসিন্দারা, এদেশের মূলনিবাসীরা কোন অধিকার, মর্যাদা কিছুই পেতনা ৷ শুধু ছিল ব্রাহ্মণের হুকুমের চাকর ৷ এসমস্ত কথাগুলোর সবটাই প্রাচীন যুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনা ৷
1947 সালে বিদেশী ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে গেল ৷ স্বাধীন ভারতকে শাসন করার জন্য ব্রাহ্মণরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নিল ৷ কংগ্রেস পার্টী, বিজেপী পার্টী, তৃণমূল কংগ্রেস পার্টী, সিপিএম পার্টী গুলোকে গঠন করেছে এবং পরিচালনা করছে ব্রাহ্মণরা ৷ কেন্দ্রে-জহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, নরসিমা রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী বা নরেন্দ্র মোদী সকলেই ব্রাহ্মণ বা তাদের অনুগত ৷ প: বঙ্গ রাজ্যে-বিধান চন্দ্র রায়, অজয় মুখার্জী, সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা ব্যনার্জী প্রমুখ ব্রাহ্মণরা শাসন ও শোষণ করে চলেছেন সেই 1947 সাল থেকে ৷ পার্টীর বদল যতই হোক ব্রাহ্মণের কোন বদল নেই ৷ বলা হয়-
By the people for the people of the people. এখন আমাদের দেশে - By the Shudra, for the Brahmin, of the Brahmin. এই অবস্থা বিরাজ করছে ৷ এই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন ও উন্নয়ণের জন্য ভারতের নাগরিক হিসাবে আমাদেরকেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে ৷
হাজার হাজার বছর ধরে যেমন শূদ্ররা কোন অধিকার পায়নি সেই রকম গত 68 বছর ধরে ভারতের Sc, St, Obc এবং মুসলমানরাও কোন অধিকার পায়নি ৷ মান-সম্মান পায়নি, উপযুক্ত শিক্ষা, সম্পদ, ক্ষমতা, নেতৃত্ব, মণ্ত্রিত্ব, সাংগঠনিক পদ কোন কিছুই পায়নি ৷ হ্যাঁ অবশ্যই পেয়েছে—" অপমান, অপদস্ত, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, অবহেলা, অনগ্রসরতা, নির্যাতন, উপেক্ষা, রক্তচক্ষু, রক্তপাত, অগ্নি সংযোগ, পুলিসের কেস, বাড়ীঘর লুটপাট প্রভৃতি ৷" তথাকথিত স্বাধীনতার নামে হিন্দু-মুসলমানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিভিন্ন জাতের মধ্যে জাতি দাঙ্গা, রাজনৈতিক দাঙ্গা, নানা ধরণের অপরাধমূলক, অসামাজিক কার্যকলাপ, রাজনৈতিক দূর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারী, নির্বাচনে কারচুপী, নির্বাচনে অর্থের অপব্যবহার, গণতণ্ত্রের অপপ্রয়োগ প্রভৃতির দ্বারা ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা বারে বারে প্রমাণিত হচ্ছে ৷ দার্শনিকদের নির্দেশিত রাজনীতি এদেশে অনুপস্থিত ৷ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি থেকে সর্বনিম্ন পদাধিকারী ব্যক্তি পর্যন্ত দূর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ৷ ন্যায়,কল্যাণ, উন্নয়ণ, শান্তি, সম্প্রীতি, মানবতা, সাম্য, হক-ইনসাফ, সুবিচার,সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ কোথায় যেন সব উবে গেছে ৷ কবি নজরুলের ভাষায় —"হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন " ?
আমার আলোচনার শিরোনামই হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতি ৷ অতএব ব্রাহ্মণ্যবাদকে না বুঝলে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতি বোঝা যাবেনা ৷ এতক্ষণ আলোচনার পর একথা বুঝতে আর এক মূহূর্ত দেরী হওয়ার কথা নয় যে, বর্তমানে রাজনীতির নামে যা হচ্ছে তা দূর্নীতি ছাড়া আর কিছু নয় ৷ কারণ ঐ একটাই—ভারতের বর্তমান রাজনীতিকে পরিচালনা করছে বা নিয়ণ্ত্রণ করছে ব্রাহ্মণরা ৷ অতএব ব্রাহ্মণদের মাথার মধ্যে যে মনুবাদ, জাতব্যবস্থা, বর্ণব্যবস্থা আছে বা সেই "divide & rull" পলিসি টাই কাজ করছে ৷ এই মনুবাদী বা ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতাই রাজনীতির সরল ও সহজ পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছে ৷ আমাদের দায়িত্ব হল আমাদের সমাজের মানুষদেরকে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা থেকে মুক্ত করে সমাজ সংস্কারের কাজে নিযুক্ত করে দেওয়া ৷