" তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে
আমরা রহিব নিচে,
অথচ তোমাকে দেবতা বলিব
সে ভরসা আজ মিছে ৷ "
বিদ্রোহী কবি-কাজী নজরুল ইসলাম
----------------------------------
কবি নজরুল ইসলামের নতুন করে কোন পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই ৷ তাঁকে বলা হয়—সাম্যের কবি ৷ হ্যাঁ, তিনি সাম্যের কবি, গরীব মানুষের কবি, অসহায় মানুষেদের কবি ৷ ঠিক তেমনই, তিনি—অসাম্য-অবিচার-অন্যায়-অত্যাচার-বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-শোষণ-বিভেদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠ ৷ তিনি তাঁর কলমকে ধারাল অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন ৷ তিনি সমস্ত প্রকারের অন্যায় বন্ধ করে — সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্ব-স্বাধীনতা-ন্যায়-সুবিচার-মুক্তি-কল্যাণ-উন্নয়ণ-মানুষের অধিকার, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন ৷
তিনি স্বাধীনতার পূর্বেই উপরোক্ত বাণী বঞ্চিত মানুষের সামনে ঘোষণা করেছিলেন যে- "তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে ---নীচে ৷" আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি যে কবির এত মূল্যবান উপদেশ আমরা অসহায়-দুর্বল-নির্যাতিত মানুষরা গ্রহণ করতে পারিনি কেন ? তার মূল কারণ কি? তার কারণ এছাড়া আর অন্য কিছু নয় যে— মানব জাতির ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, একটা জাতির হাজার-হাজার বা লক্ষ-লক্ষ বা কোটি-কোটি জনগণ সকলেই শিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সকলেই যোগ্য হতে পারেনা ৷ সেই জাতির মধ্যে যারা বুদ্ধিজীবী লোক তারা তাদের সাধারণ লোকের কাছে দার্শনিকদের বা জাতির পথ প্রদর্শকদের মূল্যবান বাণীগুলো পৌঁছে দেবে বা বাস্তবে নেতৃত্ব দিয়ে করে দেখাবে ৷ সাধারণ জনগণ যখন স্বচক্ষে দেখতে পাবে তখন তারা অনুধাবন করতে পারবে এবং তাদের কাছে মৃত ইতিহাস জীবন্ত হয়ে আশার আলো হিসাবে দেখা দেবে ৷
আমার উপরোক্ত দাবী যদি সঠিক হয় তাহলে বাস্তবের সঙ্গে একটু মিলিয়ে দেখা যাক ৷ স্বাধীনতার পূর্বে কবি নজরুল মানব জাতির জন্যে, ভারতবাসীর জন্যে, বাঙ্গালীদের জন্যে, বিশেষ করে মুসলমানদের জন্যে উপরোক্ত যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন স্বাধীনতার পর বা তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরীদের কেউ কি তাঁর উপদেশ বা নির্দেশ স্মরণে রেখে যথোপযুক্ত কোন কর্মসূচী বা কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ? আমার জানা মতে ঐ রকম সমাজ সংস্কারমূলক কোন আন্দোলন অন্ততঃ মুসলমানদের পক্ষ থেকে বা মুসলমানদের নেতৃত্বে পঃ বংলায় হয়নি এবং ভারতেও হয়নি ৷ মুসলমানদের নেতৃত্বে কিছু কিছু ধর্মীয় আন্দোলন হয়েছে ৷ সেটা একেবারে ritual বা আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ৷ তেতলার লোকদেরকে টেনে হিঁচড়ে নীচের তলায় নামিয়ে আনার কোন আন্দোলন অন্ততঃ তথাকথিত স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা করেনি ৷ কবি নজরুল এত ষ্পষ্ট ভাষায় এবং বাংলা ভাষায় বলার পরেও একাজ হল না কেন ? একথা বলা সমীচীন হবেনা যে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কবি নজরুলের কথা বুঝতে পারেন নি ৷ কাজটা হলনা কেন এর উত্তর কে দেবে ? জাতির কল্যাণে কবির ইচ্ছা ছিল— যারা উপরের তলায় বা তিন তলায় শুয়ে আছে তাদের বিরুদ্ধে যদি নিচের তলার অসহায় মানুষরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনমত গঠন করে গণতাণ্ত্রিকভাবে আন্দোলন করে তাহলে নিশ্চয় উপর তলার সংখ্যালঘু অত্যাচারী,শোষক, প্রবঞ্চক মানুষরা পরাজিত হবে ৷ কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে জালেম-অত্যাচারীদের সংখ্যা চিরদিনই কম ৷ আর নির্যাতিতরা সব সময়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ ৷ গণতণ্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরা ঐক্যবদ্ধ হলেই সংখ্যালঘু অত্যাচারীরা পরাজিত হবেই আর সংখ্যাগরিষ্ঠরা ক্ষমতা দখল করবে ৷ ইতিহাসে বহুবার একথা প্রমাণিত হয়েছে ৷ যেমন— প্রাচীন ভারতে গৌতম বুদ্ধের আন্দোলন, আরব দেশে হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আন্দোলন, নিকট অতীতে ফরাসী বিপ্লব ও অতি সম্প্রতি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ৷ এত উদাহরণ থাকা সত্বেও আধুনিক ভারতে এটা হবেনা কেন ? নিশ্চয় হবে এবং হওয়াতে হবে ৷
" তুমি শুয়ে রবে -----৷" এই কথাটি কবি কাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন ? এবং কেন বলেছিলেন ? তিনি সমাজের অসহায়, দুর্বল, নিপীড়িত, নির্যাতিত মজলূম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন যে — হে বাংলার এবং ভারতের অসহায় জনগণ, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে তোমাদেরকে ন্যায়-সাম্য-সুবিচার থেকে বঞ্চিত করেছে তাদের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে গর্জে ওঠ ৷ অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয় না, যারা মানুষকে পশুরও অধম মনে করে, যারা মানুষকে নীচ-হীন চোখে দেখে, যারা মানুষকে ভায়ের মর্যাদা দেয় না, যারা সংখ্যায় মাত্র 3 % হয়ে দেশের আইন-কানুন সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে স্বাধীনতার সমস্ত সম্পদ ও সুখ-সুবিধা ভোগ করে আসছে তাদের বিরুদ্ধে সবথেকে বড় অস্ত্র হল স্বাধীন ভারতের সংবিধান ৷ শিক্ষিত মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে ঐ সংবিধান হাতে নিয়ে আগিয়ে চলুন আর বলতে থাকুন— চল্ চল্ চল্ ৷
চল্ রে চল্ রে চল্ ৷
চল্ চল্ চল্ ৷